ছোটকাগজ অচল ধারা ভাঙে, নতুন কিছু দাবি করে: নাজমুল আরেফীন

[সম্ভাবনাময় তরুণ প্রাবন্ধিক নাজমুল আরেফীনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাপ্তাহিক বিক্রমপুর সংবাদের উপসম্পাদক মাসুদ অর্ণব]
বি.সংবাদ: নাজমুল, লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ হলেন কীভাবে?
নাজমুল আরেফীন: লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য একজন ভালো পাঠক হওয়া জরুরী। আমার পরিবারের প্রায় সবাই ভালো পাঠক। সাহিত্যের যেকোনো বিষয়ে পরিবারের আলোচনা-সমালোচনা আমাকে ভাবতে শিখায়,আর আমাকেও লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ করে।
বি. সংবাদ: সব লেখকই পাঠক, কিন্তু সব পাঠক লেখক না। এই দুই ধরনের পাঠকের মাঝে পার্থক্যগুলো কোথায় ?
নাজমুল আরেফীন: লেখক-পাঠক এবং শুধু পাঠকের মধ্যে মূল পার্থক্যটি নিহিত তাদের উদ্দেশ্য, দৃষ্টিভঙ্গি এবং পড়ার ফলাফলের মধ্যে। লেখক-পাঠক পড়াকে একটি শৈল্পিক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার অংশ হিসেবে দেখেন, যেখানে পাঠক পড়াকে শুধু বিনোদন বা জ্ঞানার্জনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন।
বি.সংবাদ: প্রগতিশীলতার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানমনস্কতার ভূমিকা কেমন?
নাজমুল আরেফীন: বিজ্ঞানমনস্কতা প্রগতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। এটি যুক্তি, তথ্যভিত্তিক চিন্তা, এবং সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূর করে, সমাজে উন্মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদ্ভাবনী সমাধানের পথ প্রশস্ত করে। বিজ্ঞানমনস্কতা মানুষকে প্রশ্ন করতে, সত্য অনুসন্ধান করতে এবং পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে। যা প্রগতির মূল ভিত্তি।
বি. সংবাদ: তুমি তো মূলত প্রবন্ধই লিখো, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তোমার কোনো প্রবন্ধের বই প্রকাশ পায় নি কেন? অদূর ভবিষ্যতে প্রকাশ পাবে কি?
নাজমুল আরেফীন: প্রবন্ধের বই প্রকাশের ব্যাপারে আমার এখনো আগ্রহ প্রকাশ পায়নি। কারণ বই প্রকাশের জন্য আরো সাধনার প্রয়োজন, প্রয়োজন আরো লেখা, আর বিষয় বৈচিত্র্যের দিকে নতুন দৃষ্টিকোণ তুলে ধরা। অদূর ভবিষ্যতে যদি পাঠক মনে করে আমার প্রবন্ধের বই প্রকাশ করা দরকার, তখন ভেবে দেখব।
বি.সংবাদ: তুমি তো ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। বাংলা সাহিত্যে দুই বাংলায় তোমার প্রিয় কবি-সাহিত্যিক কারা?
নাজমুল আরেফীন: বাংলা সাহিত্যে দুই বাংলার (পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ) প্রেক্ষাপটে আমার পছন্দের কবি ও সাহিত্যিক নির্বাচন করা বেশ কঠিন। কারণ এই সাহিত্যের ঐশ্বর্য অপরিসীম। তবুও কিছু নাম উল্লেখ করছি, যাঁদের সৃষ্টি আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে: শীষের্ন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী এবং বিষ্ণু দে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির, শামসুর রাহমান, হুমায়ূন আহমেদ, জাকির তালুকদার ও শাহাদুজ্জামান।
বি.সংবাদ: বাংলা সাহিত্যে লেখক সৃষ্টির ক্ষেত্রে ছোটকাগজের ভূমিকা কতটুকু?
নাজমুল আরেফীন: অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও ছোটকাগজ টিকে থাকে এবং নতুন প্রতিভার জন্ম দেয়। জীবনানন্দ, সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রজন্মের বহু কবি-লেখক প্রথম পরিচিতি পান ছোটকাগজে। ছোটকাগজ কেবল সাহিত্য প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং এক ধরনের মতাদর্শিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রও বটে। ছোটকাগজ মূলধারার সাহিত্যজগৎকে প্রশ্ন করে, অচল ধারা ভাঙে, নতুন কিছু দাবি করে। বাংলা গদ্য-আধুনিকতার ইতিহাসেও এর বড় ভূমিকা রয়েছে। সময়ের সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজভাবনা, ছোটকাগজে রেকর্ড হয়ে যায়। অনেক সময় তা একেকটি যুগের চিন্তার ইতিহাস লিখে রাখে। বাংলা সাহিত্যে লেখক সৃষ্টিতে ছোটকাগজ এক উর্বর জমি। যা নতুন কণ্ঠের জন্ম দেয়, পুরনোকে চ্যালেঞ্জ করে, সাহিত্যের পরিসরকে সমৃদ্ধ করে।
বি. সংবাদ: একজন লেখকের রাজনৈতিক সচেতনতা অবশ্যই জরুরি। এ বিষয়ে তোমার মতামত কি?

নাজমুল আরেফীন: হ্যাঁ, একজন লেখকের রাজনৈতিক সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। তবে সেটা কোনো দলীয় আনুগত্য নয়, বরং সমাজ, ক্ষমতা, ন্যায়ের প্রশ্নে তার দায়বদ্ধতা বোঝা। নির্বাচন নয়। সমাজের ক্ষমতার কাঠামো, শোষণ-বৈষম্য, অধিকার, ন্যায়-অন্যায়ের লড়াই সবই এর অন্তর্ভূক্ত। একজন লেখক যদি এগুলো না বোঝে, তাহলে তার লেখা হয় নিস্তরঙ্গ, বাস্তবতা-বিচ্ছিন্ন, প্রায় “কৃত্রিম”।
বি. সংবাদ: ব্যাংকার, ব্যবসায়ী ও প্রাবন্ধিক, কোন পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দবোধ করো?
নাজমুল আরেফীন: ব্যাংকার, ব্যবসায়ী বা প্রাবন্ধিক কোনো পরিচয়ই আসলে কারো পরিচয় হতে পারে না। আর আমি নিজেকে একজন সাধারণ মানুষ পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করি।
বি. সংবাদ: নাজমুল তোমাকে ধন্যবাদ।
নাজমুল আরেফীন: আপনাকেও ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *